22 C
Dhaka
রবিবার, ডিসেম্বর ২২, ২০২৪

হিজবুল্লাহ কারা, কতটা শক্তিশালী তারা?

সিরাজুম মুনির শুভ,নাগরিক টিভি: গাজা যুদ্ধের কারণে গত ১১ মাসে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে আন্তঃসীমান্ত লড়াই উল্লেখযোগ্যভাবে তীব্র হয়েছে। লেবাননে ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহকে লক্ষ্য করে সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ভোরে স্মরণকালের ভয়াবহ বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। যেখানে প্রায় ৬শ মানুষের প্রাণ গেছে। আহত হয়েছে আরও ১ হাজার ৮৩৫ জন।

হামলার কয়েক ঘণ্টা আগেই ফোনে হিজবুল্লাহ থেকে দূরে থাকো এমন সতর্কবার্তা পায় লেবাননের বাসিন্দারা। ইসরায়েল বলছে, বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি কমাতে, বোমা হামলার আগে তাদের সেনাবাহিনী এই সতর্কবার্তা পাঠায়। বলা বাহুল্য, গাজায় চলমান যুদ্ধের সময়ও একই যুক্তি দেখিয়েছিল দেশটি।

লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল ও রাজধানী বৈরুতের কিছু অংশে ইসরায়েল হামলা চালানোর পর, দেশটির উত্তরাঞ্চলে কয়েকশ রকেট ছুড়ে জবাব দিয়েছে হিজবুল্লাহও। এতে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা থেকে শুরু হওয়া সংঘাত, লেবানন হয়ে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ নেওয়ার শঙ্কা তৈরি করেছে।

অস্থিরতার পারদ যখন তুঙ্গে তখন স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, কারা এই হিজবুল্লাহ, কোথায় কাজ করে, তাদের শক্তিই বা কতটুকু?

এ নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক গণমাধ্যম সংস্থা বিবিসি। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, হিজবুল্লাহ একটি শিয়া মুসলিম রাজনৈতিক দল ও সশস্ত্র গোষ্ঠী। লেবাননের পার্লামেন্ট ও সরকারে দলটির উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনীকেও নিয়ন্ত্রণ করে হিজবুল্লাহ।

হিজবুল্লাহর আবির্ভাব মূলত ১৯৮০-র দশকে, ইসরায়েল বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে। লেবাননে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ এর গৃহযুদ্ধ চলার সময়, দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয় হিজবুল্লাহ।

ইরানের কাছ থেকে বহু বছর ধরেই আর্থিক ও সামরিক সমর্থন পেয়ে আসছে গোষ্ঠীটি। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদেরও ঘনিষ্ঠ মিত্র হিজবুল্লাহ।

লেবানন থেকে ২০০০ সালে ইসরায়েল যখন সেনা প্রত্যাহার করে, তখন হিজবুল্লাহ তাদের দেশছাড়া করার কৃতিত্ব দাবি করে। পরে সীমান্তের বিরোধপূর্ণ এলাকাগুলোতেও ইসরায়েলের অবস্থানের বিরোধিতা অব্যাহত রাখে।

ইসরায়েল–লেবানন সীমান্তে হিজবুল্লাহর তৎপরতাকে ঘিরে ২০০৬ সালে পুরোদস্তুর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েল। ওই যুদ্ধে ইসরায়েলি সেনারা দক্ষিণ লেবাননে ঢুকে পড়ে এবং সেখান থেকে হিজবুল্লাহকে নির্মূল করার চেষ্টা চালায়। লড়াইয়ে প্রাণ হারায় প্রায় এক হাজার বেসামরিক নাগরিক। পরে হিজবুল্লাহ জয়ী হওয়ার দাবি করে এবং সেই থেকেই নিজেদের যোদ্ধার সংখ্যা বাড়ানো ও অস্ত্রশস্ত্র সমৃদ্ধ করা শুরু করে।

হিজবুল্লাহর রাজনৈতিক সমর্থন কতটা?

লেবাননে ১৯৯২ সাল থেকে জাতীয় নির্বাচনে নিয়মিতভাবে অংশ নিচ্ছে হিজবুল্লাহ। যার মধ্যদিয়ে একটি প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে তারা। ২০২২ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে হিজবুল্লাহ ও এর মিত্ররা সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। তবে তখন থেকে এখন পর্যন্ত লেবাননে কোনো নতুন সরকার গঠিত হয়নি। দেশটি চলছে তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনের অধীনেই।

হিজবুল্লাহকে নিয়ে লেবাননের বাসিন্দাদের মধ্যে বিভক্তি আছে। তবে বাস্তবে হিজবুল্লাহর ব্যাপক জনসমর্থন আছে। অনেকের অভিযোগ, সংগঠনটি রাজনৈতিকভাবে দুর্নীতিতে জড়িত। তাদের দাবি, দেশের চলমান সংঘাতের জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে দায়ী হিজবুল্লাহ।

হিজবুল্লাহ কতটা শক্তিশালী?

হিজবুল্লাহর বহরে যোদ্ধা আছে হাজার হাজার, আছে দক্ষিণ লেবাননে ক্ষেপণাস্ত্রের বিশাল ভাণ্ডার। বিশ্বের অন্যতম সশস্ত্র বেসরকারি সামরিক সংগঠন হিসেবেও হিজবুল্লাহকে বিবেচনা করা হয়। সংগঠনটিকে অর্থ ও অস্ত্রসরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করে ইরান।

হিজবুল্লাহর দাবি, তাদের যোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ। যদিও অনেক সংবাদ মাধ্যমের হিসাবে এটি ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার। হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা সুপ্রশিক্ষিত ও যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে লড়াই করেছে এ বাহিনীর সদস্যরা।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের তথ্যমতে, হিজবুল্লাহর ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ২ লাখ রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। হিজবুল্লাহর অস্ত্রভান্ডারে থাকা এসব রকেটের বেশির ভাগই আকারে ছোট, আনগাইডেড, ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য।

তবে সশস্ত্র সংগঠনটির বিমান ও যুদ্ধজাহাজবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং ইসরায়েলের একেবারে ভেতরে আঘাত হানতে সক্ষম ‘গাইডেড’ ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে বলেও খবর আছে। লেবাননে হিজবুল্লাহর রয়েছে, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র।

হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরুল্লাহ কে?

শিয়া নেতা হাসান নাসরুল্লাহ ১৯৯২ সাল থেকে হিজবুল্লাহর নেতৃত্বে আছেন। সংগঠনটিকে একটি রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে নাসরুল্লাহর। ইরান ও এর সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সঙ্গেও হাসান নাসরুল্লাহর রয়েছে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।

নাসরুল্লাহ কয়েক বছর ধরেই জনসমক্ষে আসছেন না। ইসরায়েলের হাতে হত্যার শিকার হওয়া থেকে বাঁচতেই তিনি লোকচক্ষুর আড়ালে আছেন। এমন ধারণা বিশ্লেষকদের। প্রকাশ্যে না এলেও হিজবুল্লাহর কাছে নাসরুল্লাহর আবেদন বলবৎ আছে। প্রতি সপ্তাহে সম্প্রচার করা হয় তাঁর টেলিভিশন ভাষণ।

গত ৩০ জুলাই ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী (আইডিএফ) ঘোষণা দেয়, বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠে তাদের এক বিমান হামলায় হিজবুল্লাহর জ্যেষ্ঠ সামরিক কমান্ডার ফুয়াদ শোকর নিহত হয়েছেন। পরদিন ফিলিস্তিনের হামাসপ্রধান ইসমাইল হানিয়া, ইরানের রাজধানী তেহরানে হামলায় নিহত হন। এ ঘটনায় ইসরায়েলকে দায়ী করা হলেও, এটি স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটিই করেনি দেশটি।

এরপর গত ২৫ আগস্ট আইডিএফ আবারো দাবি করে, হিজবুল্লাহ তাদের জ্যেষ্ঠ নেতা ফুয়াদ হত্যার প্রতিশোধ নিতে, ইসরায়েলে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন খবরে লেবাননের দক্ষিণে সংগঠনটির হাজারো রকেট লঞ্চার লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায় নেতানিয়াহুর সেনারা।

ওই ঘটনায় হিজবুল্লাহও ইসরায়েলে রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। সংগঠনটি বলছে, ইসরায়েলে শত শত রকেট ও ড্রোন হামলা চালাতে সক্ষম তারা। তবে তারা দেশটির প্রধান প্রধান শহরকে নিশানা বানায়নি এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রও ব্যবহার করেনি।

দুইপক্ষের সাম্প্রতিক এই উত্তেজনা বেড়ে গেছে গত ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর লেবাননে হাজারো পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণের ঘটনার পর। এসব বিস্ফোরণে ৩৯ জন নিহত ও কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছেন।

ওই আক্রমণের জন্য হাসান নাসরুল্লাহ ইসরায়েলকে দায়ী করেছেন, বলেছেন ‘ইসরায়েল সব রেডলাইন অতিক্রম করেছে।’

২০ সেপ্টেম্বর বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠে ইসরায়েলের আরেকটি বিমান হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষস্থানীয় দুই সেনাকমান্ডার ইব্রাহিম আকিল ও আহমেদ ওয়াহবিসহ সংগঠনটির অন্তত ১৬ জন সদস্য নিহত হন। হামলায় নিহত হয় কয়েকটি শিশুসহ অন্যান্য বেসামরিক লোক।

এই ঘটনার দুদিন পর হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের একেবারে ভেতরে দূরপাল্লার রকেট ছোড়ে। এতে হাইফা শহরের কাছে কিছু বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং হামলা থেকে বাঁচতে হাজারো ইসরায়েলি আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেয়।

হিজবুল্লাহ কি ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে যাবে?

পেছনের বিক্ষিপ্ত লড়াই ২০২৩ সালের ০৮ অক্টোবর তীব্র হয়ে ওঠে গাজা থেকে ইসরায়েলে হামাসের অভূতপূর্ব আক্রমণের পর। যখন হেজবুল্লাহ ফিলিস্তিনিদের সাথে সংহতি প্রকাশ করে ইসরায়েলি অবস্থানে গুলি চালায়।

এরপর গোষ্ঠীটি উত্তর ইসরায়েল ও গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলি অবস্থানগুলি লক্ষ্য করে আট হাজারেরও বেশি রকেট ছোড়ে। সাঁজোয়া যানে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ এবং বিস্ফোরক ড্রোন দিয়ে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ চালায়।

এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) লেবাননে হেজবুল্লাহ অবস্থান লক্ষ্য করে বিমান হামলা এবং ট্যাঙ্ক ও আর্টিলারি দেগে প্রতিশোধ নেয়।

লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে কমপক্ষে ৫৮৯ জন নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই হেজবুল্লাহ যোদ্ধা। এর মধ্যে ১৩৭ জন ছিলেন বেসামরিক নাগরিক। অন্যদিকে, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের তথ্য দেখাচ্ছে, হামলায় কমপক্ষে ২৫ জন বেসামরিক নাগরিক এবং ২১ জন সেনা নিহত হয়েছেন।

যুদ্ধ সত্ত্বেও, পর্যবেক্ষকরা বলছেন এখন পর্যন্ত উভয় পক্ষই পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধে যাওয়ার সীমা অতিক্রম না করে শত্রুতা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

ইসরায়েল-অধিকৃত গোলান মালভূমিতে গত ২৭ জুলাই রকেট হামলায় ১২ শিশু নিহত হওয়ার পর, সেই আশঙ্কা আরও বেড়ে গেছে। ইসরায়েল এই হামলার জন্য হেজবুল্লাহকে দায়ী করলেও, গোষ্ঠীটি জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে।

আইডিএফ ৩০ জুলাই ঘোষণা করে যে, তারা বৈরুতের দক্ষিণের শহরতলীতে একটি বিমান হামলা চালিয়ে হেজবুল্লাহর সিনিয়র সামরিক কমান্ডার ফুয়াদ শুকুরকে হত্যা করেছে। পরদিন ইরানের রাজধানী তেহরানে হামাসের রাজনৈতিক নেতা ইসমাইল হানিয়েহ মারা যান। যা নিয়ে কোন মন্তব্য করেনি ইসরায়েল। তখন থেকেই, হেজবুল্লাহ ও ইরানের প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা শুরু হয়েছে। কারণ দুই পক্ষই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি মুক্তি চুক্তির মধ্য দিয়ে উত্তেজনা কমানোর আশা করছে এবং সেই লক্ষ্যে ইসরায়েল ও হামাসের উপর চাপ দিচ্ছে। কিন্তু হেজবুল্লাহ বলছে গাজায় যুদ্ধ শেষ হলেই কেবল এই শত্রুতার অবসান ঘটাবে তারা।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

বিশেষ প্রতিবেদন