হাসিনার ভারত থাকা, ভারত ছাড়া নিয়ে অনেক জল ঘোলা হলেও দিল্লি এখনও হাসিনার অবস্থান নিয়ে একটি শব্দও খরচ করছে না। ভারত সরকার স্পষ্ট আওয়াজ দিলেই সব কৌতুহলের অবসান হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে মুখে কুলুপ এটেছেন ভারতের দায়িত্বশীলরা। হাসিনার অবস্থান নিয়ে যে টম এন্ড জেরি খেলা শুরু হয়েছে তাতে নতুন করে ইতিহাসের পাতা ঘাটাঘাটি চলছে শ্বৈরাশাসকদের আশ্রয় দেয়া দেশগুলোর নিয়ম নীতি নিয়ে।
দেশ ত্যাগী শ্বৈরাশাসকরা কোন কোন দেশে যেতে পারেন? একটি রাষ্ট্রের নিন্দিত ব্যক্তিকে আরেকটি রাষ্ট্র কেনই বা আশ্রয় দেয়? যেসব দেশের শ্বৈরাশাসকরা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, তারা কোথায় যান? যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো ইউনিভার্সির দ্য জার্নাল অব পলিটিক্স-এ আবদেল এসক্রিবা এবং ড্যানয়িলে ক্রাকমারকি এক গবেষণা মূলক নিবন্ধ লিখেছেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে শ্বৈরাশাসকরা যেসব দেশে পালিয়ে আশ্রয় নিতে চায় সেখানে কী কী বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়।
ক্ষমতাচ্যূত হয়ে পালিয়ে যাওয়া শাসকরা যেসব দেশে আশ্রয় প্রার্থনা করে সে দেশগুলো মূলত কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেগুলো হলো- দেশটির সাথে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় মিল কতটুকু রয়েছে, ভৌগলিক দুরত্ব কতটা?, দেশটি অতীতে কোন শ্বৈরাচারদের আশ্রয় দিয়েছে কী না? দেশটি সামরিকভাবে শক্তিশালী কী না? এসব বিষয় বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এদিকে ক্ষমতাচ্যুত শ্বৈরাশাসক সাধারণত গণতান্ত্রিক দেশে আশ্রয় নিতে চায় না বলে উল্লেখ করেন আবদেল এসক্রিবা এবং ড্যানয়িলে ক্রাকমারকি।
অতীতে দেখা গেছে মুসলিম প্রধান দেশগুলো থেকে পালিয়ে যাওয়া শাসকরা অনেকেই সৌদি আরবে আশ্রয় নিয়েছেন। ২০২২ সালে মিডিল ইষ্ট আই পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে সৌদি আরব যাদের আশ্রয় দিয়েছে তাদের অধিকাংশ খরচ বহন করছে সৌদি সরকার। এছাড়া পশ্চিমা দেশেও আশ্রয় নেয়ার নজির রয়েছে।
জনরোষে পড়ে দেশ ত্যাগ করে অন্যদেশে স্থায়ী কিংবা সাময়িকভাবে আশ্রয় নেওয়া নেতাদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। হাসিনা ছাড়া এই তালিকায় আরও আছেন ইউক্রেনেরে ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ, উগান্ডার ইদি আমিন, তিউনিসিয়ার বনে আলী, আফগানিস্তানের আশরাফ ঘানি, ফিলিপিন্সের মার্কোস, ইরানের রেজা শাহ, পাকিস্তানের নেওয়াজ শরীফ ও পারভেজ মোশাররফ, থাইল্যান্ডের থাকসিন সিনাওয়াত্রা, শ্রীংলকার রাজাপাকশা প্রমুখ।
ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ
ইউক্রেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ রাশিয়া পন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ২০১৪ সালে বিক্ষোভ হলে তিনি বাধ্য হন পালিয়ে যেতে, আশ্রয় পান রশিয়ায়। উগান্ডার ইদি আমিন ১৯৭০ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মানবাধিকার, বিচারবর্হিভূত হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হন। জনরোষের মুখে ১৯৭৯ সালে দেশ ছেড়ে পালিয়ে সৌদি আরব আশ্রয় নেন। ২০১১ সালে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার কয়েকটি দেশে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা শ্বৈরাশাসকদের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন শুরু হলে ক্ষমতাচ্যূত হন তিউনিসিয়ার বনে আলী। ২৩ বছর পর দেশ থেকে পালিয়ে বনে আলী আশ্রয় নেন সৌদি আরব।
আশরাফ ঘানি
২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার সৈন্য প্রত্যাহারের পর তালেবান যোদ্ধারা দ্রুত রাজধানী কাবুল দখল করে। এসময় দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি। প্রথম দিকে তার অবস্থান অস্পষ্ট থাকলেও পরে নিশ্চিত হওয়া যায় ঘানি আরব আমিরাতে আশ্রয় নিয়েছেন। জনপ্রতিরোধে ১৯৮৬ সালে ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট মার্কোস ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে চলে যান। যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় চাইলেও রোনাল্ড রিগান রাজি হননি। পরে মার্কোস আশ্রয় নেন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ গুয়ামে। ইরানে ইসলামী বিপ্লবের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন রেজা শাহ পাহলভি। প্রথমে তিনি মরক্কো যান, তারপর ম্যক্সিকো হয়ে আমেরিকায় আশ্রয় পান। কিন্তু সেখানেও থাকতে পারেনিনি। জনরোষে আমেরিকা ছেড়ে পানামা হয়ে ফের মিশর গিয়ে স্থায়ী হন রেজা শাহ।
নওয়াজ শরীফ
পাকিস্তানের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফ ১৯৯৯ সালে ক্ষমতাচ্যূত হন। আমেরিকা আর সৌদি আরবের মধ্যস্থতায় সৌদিতেই নির্বাসনে থাকেন নেওয়াজ শরীফ। পরে লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান। পট পরিবর্তনের পর ২০২৩ সালের অক্টোবরে তিনি আবার পাকিস্তান ফিরে যান। পাকিস্তানের পারভেজ মুশাররফও দেশ ছাড়তে বাধ্য হন নির্বাচনের হারার পর। তার স্থায়ী বন্দোবস্ত হয়েছিলো দুবাইতে। মাঝে একবার পকিস্তান ফিরে নির্বাচনে অংশ নিলেও গ্রেফতার এড়াতে পারেননি। পরে শারিরিক অসুস্থতার কথা বলে আবারও দুবাই চলে যান এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন।
থাকসিন শিনাওয়াত্রা
থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন শিনাওয়াত্রা ২০০৬ সালে ক্ষমতাচ্যূত হয়ে লন্ডন চলে যান। ১৫ বছর নির্বাসনে থাকার পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। ২০২২ সালে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসা গণআন্দোলনের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। দেশ ছেড়ে পালিয়ে তিনি সিঙ্গাপুরে আশ্রয় নেন। এরপর যান থাইল্যান্ড। দুই মাস পর রাজাপাকশা আবার দেশে ফিরে আসেন।
শ্বৈরাশাসক হিসেবে খেতাব পাওয়া প্রায় ডজন খানেক রাষ্ট্রনেতার দেশত্যাগের যে ইতিহাস পাওয়া যায় তাতে শেখ হাসিনা সরকারের পতন আর ত্যাগ দেশের ঘটনার মিলতাল অনেক । এখন দেখার বিষয় হাসিনা শেষ মেষ কোন ফ্লাইটে সাওয়ার হন। নাকি তার দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী টুস করে দেশে ঢুকে পড়বেন। শেখ হাসিনার স্থায়ী বন্দোবস্তের খবর জানতে এখন কৌতুহল নিয়েই অপেক্ষা করছেন ১৮ কোটি বাংলাদেশি।