বাংলাদেশে পটপরিবর্তনের পর থেকে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে চলছে টানাপোড়েন। আর এর সঙ্গে ধীরে ধীরে জড়িয়ে যাচ্ছে বাণিজ্যিক আদান-প্রদানও। সবশেষ ইসকন ইস্যুতে আরো কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছে ভারত। ভারত সরকার সরাসরি কোনো সিদ্ধান্ত না নিলেও দেশটির ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বাণিজ্যে বাধা দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। উগ্রপন্থীরা আবার কোথাও কোথাও বিক্ষোভ করে বন্ধ করে দিচ্ছে স্থলবন্দরের কার্যক্রম। এতে ব্যাহত হচ্ছে দুই দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি।
এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশ কি পণ্য আমদানীতে কেবল ভারতের উপরেই নির্ভরশীল? সাম্প্রতিক ইসকন ইস্যুতে চিন্ময়ের গ্রেপ্তার নিয়ে ফুঁসে উঠেছে ভারত। নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। পণ্য রপ্তানী বন্ধে দেয়া হচ্ছে হুমকি। তাদের এমন হুমকীর বিপক্ষে শক্ত অবস্থানে বাংলাদেশ। সরকার থেকে সাধারণ মানুষ ভারতের এহেন আচরনে ক্ষুব্ধ। ভারতীয় পণ্য বর্জনেরও শোরগোল দেশের আনাচে কানাচে।
দেশের মানুষ বলছে, ভারতের কব্জা থেকে বেরোতে হবে। বিকল্প পথ খুজে পেতে হবে। এমন পরিস্থিতে এক সু খবর হলো- পাকিস্তানের কাছে থেকে ২৫ হাজার টন উচ্চমান সম্পন্ন চিনি কিনেছে বাংলাদেশ। আগামী মাসে করাচি বন্দর থেকে এসব চিনি চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে বাংলাদেশ পৌঁছানোর কথা রয়েছে। কয়েক দশক পর ইসলামাদ থেকে এতো বিপুল পরিমাণে চিনি কিনল ঢাকা। এর আগে বেশিরভাগ সময় ভারতের কাছ থেকে চিনি কিনত বাংলাদেশ। এবার ভারতের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় এই নিত্যপণ্য পাকিস্তান থেকেও কিনছে ঢাকা।
যদিও দীর্ঘ দিনের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে, পাকিস্তানের করাচি থেকে কনটেইনার পণ্যবাহী একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে গত নভেম্বরের মাঝামাঝি। এমভি ইউয়ান জিয়ান ফা ঝং’ নামের জাহাজটি করাচি থেকে দুবাই হয়ে চট্টগ্রামে আসে। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর করাচি থেকে সরাসরি চট্টগ্রামে নোঙর করা প্রথম কোনও জাহাজ এটি।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে জটিল এবং কখনও কখনও উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক বৈরিতার কারণে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য কয়েক দশক ধরে সীমিত থাকলেও পুরোপুরি বন্ধ ছিল না। তবে নতুন করে ক্রয় দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্কের উন্নতির দিকে একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্য, গার্মেন্ট, মেডিসিন, লেদার – এসব ক্ষেত্রে পাকিস্তানে রপ্তানি বাড়ানোর সম্ভাবনা বেশি। অন্যদিকে পাকিস্তানের সিলিং ফ্যান, ফ্রুটস, জুস, মেয়েদের ড্রেস বাংলাদেশে জনপ্রিয়। কস্ট বেনিফিট পর্যালোচনা করে আমদানি-রপ্তানির পণ্য ঠিক হলে উভয় দেশই তাতে লাভবান হবে।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ব্রাজিল থেকে গম, চিনি, মাংস এবং নানা ধরনের শুকনো ফল ও মসলা আমদানি করে বাংলাদেশ। মালয়েশিয়া থেকে ভোজ্যতেল, রাবার, দুগ্ধপণ্য, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, রাসায়নিক পদার্থ, জুতা ও চামড়াজাত পণ্য। খাদ্যশস্য ও বীজ, গম এবং ডালের উল্লেখযোগ্য আমদানি হিস্যা রাশিয়ার হাতে। জাপান থেকে আমদানি হয় গাড়ি, ইস্পাতের কাঁচামালসহ শিল্পের যন্ত্র। সিঙ্গাপুর থেকে মূলত জ্বালানি আমদানি করা হয়। পাশাপাশি দেশটি থেকে কাঁচা তুলা, ডাল, গম, তেলবীজ ও পাম অয়েলসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য আসে। এর সাথে পাকিস্তান নিত্য পণ্য রপ্তানী শুরু করলে ভারতের পণ্য না পেলেও বাংলাদেশ না খেয়ে মরবে না, এটা বলাই যায়।
বাণিজ্য বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাজনৈতিক বিভেদ বা দূরত্ব থেকে বাণিজ্যকে মুক্ত রাখতে হবে। অনভিপ্রেত ঘটনার প্রভাব যদি আমদানি-রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার মতো পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়, ক্ষতিটা ভারতেরই হবে। কেননা, প্রতিবছর বাংলাদেশ ভারত থেকে ১৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য ও সেবা আমদানি করছে। এর বিঘ্ন ঘটলে ভারত সেই বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হবে।
অন্যদিকে রপ্তানি বন্ধ করলে সাময়িক সময়ের জন্য বাংলাদেশ কিছুটা চাপে পড়লেও আমদানির নতুন বিকল্প উৎস ঠিকই খুঁজে পেয়ে যাবে। তদুপরি অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়িয়েও তা মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে। অর্থাৎ এতে কার লাভ, কার ক্ষতি, সেটি ভারতকে যেমন বিবেচনা করতে হবে, তেমনি বাংলাদেশকেও আঞ্চলিক বাণিজ্য থেকে সময় ও ব্যয় দুটির সুবিধাই ধরে রাখার চেষ্টা করতে হবে।
অন্যদিকে এক সময় বাংলাদেশি পাট ও পাটজাত দ্রব্যের প্রচুর চাহিদা ছিলো পাকিস্তানে। সেটি এখন তেমন না থাকলেও বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল আসছে। আমাদেরও গার্মেন্টস সহ বিভিন্ন পণ্য অল্প হলেও যাচ্ছে। তাই উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার জন্য একটি যৌথ কারিগরি দল গঠন করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে বিনিয়োগভিত্তিক বাণিজ্য সম্পর্ক তৈরির সুযোগ তৈরি হতে পারে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।