ইউরোপের দেশ সুইডেন শান্তিপ্রিয় হিসেবেই খ্যাত। ১৮১৪ সালের পর প্রায় দেড়শ বছর দেশটি কোনো দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ২০ বছর পর সুইডেনই চেয়েছিলো সেনাবাহিনীকে পরমাণু শক্তিধর করতে। ১৯৬৮ সালে সুইডেনের সরকার দীর্ঘ তর্কের পর বোমা তৈরির সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। পরমাণু অস্ত্র তৈরির কর্মসূচি থেকে সরে আসা সুইজারল্যান্ড, ইউক্রেন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ইউনিক ক্লাব অব ন্যাশনসে যোগ দেয় সুইডেন এবং বিশ্বকে দেখায়; পরমাণু নিরস্ত্রিকরণ সম্ভব।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পেক্ষাপটেই প্রায় ২শ বছরের নিরপেক্ষ নীতি থেকে সরে এসে পরমাণু ক্ষমতাধর ইউরোপের সামরিক জোট ন্যাটোতে সুইডেনের যোগদানের সিদ্ধান্ত এসেছে। প্রশ্ন থেকে গেছে, কেন তবে সুইডেন পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে চেয়েছিলো এবং কেনইবা কর্মসূচি বাতিল করে?
সুইডেনের নেতারা বিশ্বাস করতেন, নিরপেক্ষ থাকার পুরস্কার হতে পারে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী এবং ভবিষ্যতেও এই নিরপেক্ষতা ধরে রাখার জন্য পরমাণু ক্ষমতাধর হওয়া প্রয়োজন। দীর্ঘ উপকূলীয় এলাকা এবং ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সুইডেন খুব সহজেই রাশিয়ার মতো প্রতিপক্ষের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে।
সুইডেনের ওই পরমাণু কর্মসূচি যেসব স্থান ঘিরে তার অন্যতম দেশটির সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা গবেষণা সংস্থার (এফওএ) প্রধান কার্যালয়। হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু হামলার ৩ বছর পর ১৯৪৮ সালে এফওএ থেকে বিদেশী সাহায্য ছাড়া পরমাণু বোমা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রকেও সুইডেন ওই পরমাণু কর্মসূচির কোনো তথ্য দেয়নি। সুইডেনের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে লেখা ‘দ্য কি টু নিউক্লিয়ার রেস্ট্রেইন্ট: দ্য সুইডিশ প্ল্যান টু অ্যাকুয়ার নিউক্লিয়ার উয়েপনস ডিউরিং দ্য ক্লোড ওয়ার’ বইয়ের লেখক থমাস জন্টার জানিয়েছেন, ‘‘অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় প্লটোনিয়াম আমাদের কাছে ছিলো। অস্ত্র তৈরির জন্য স্টকহোমের দক্ষিণে ‘অগেস্টা’ এবং নরকোপিন শহরের বাইরে ‘মারভিকেন’ নামে দুটি পরমাণু চুল্লিও তৈরি করা হয়। তবে উৎপাদন শুরু করতে পারেনি। আমরা জানতাম ঠিক কিভাবে এটা করতে হবে। অস্ত্র বাহক পদ্ধতি এবং পুনঃপ্রকিয়াকরণ পদ্ধতি বাদে আমাদের কাছে সবকিছুই ছিলো।’’
ওই পরমাণু কর্মসূচি সম্পর্কে তর্ক বেশি হয়নি কারণ কয়েকজন রাজনীতিবিদ, উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা, বিজ্ঞানীরা ও সম্ভবত রাশিয়ার কিছু গোয়েন্দা কেবলমাত্র এ বিষয়ে অবজ্ঞত ছিলো। ১৯৫৪ সালে এ গোপনিয়তা শেষ হয় যখন সুইডেনের কমান্ডার-ইন-চিফ নিলস সুয়েডলান্ড পরমাণু কর্মসূচির অস্তিত্বের কথা প্রকাশ করেন এবং সোভিয়েত হামলা পরাজিত করতে অস্ত্রের প্রয়োজনিয়তার কথা তুলে ধরেন। ১৯৫৭ সালের এপ্রিলে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি-সিআইএ জানায়, আগামী ৫ বছরের মধ্যে পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি করে ফেলেছে সুইডেন, পরবর্তিতে সময়সীমা আরোও কমিয়ে ৪ বছর বলা হয়।
সেসময় সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী এরল্যান্ডার বিশ্বের নামকরা পদার্থবিদদের সঙ্গে পরমাণু অস্ত্রের বিষয়ে নিয়মিত আলোচনা করতেন। সেসময় সামাজিক-গণতান্ত্রিক মতাদর্শের নারীদের একটি অংশ পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে গবেষক ইমমা রোজেনগ্রিন জানান, নারীদের অবস্থান ছিলো এমন- ‘‘বেশ কয়েক কারণে সুইডেনের পরমাণু অস্ত্রের অধিকারি হওয়ার প্রয়োজন নেই। নিরাপত্তা দেওয়ার পরিবর্তে এ অস্ত্র সুইডেনকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে পারে। পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার হবে সম্পূর্ণ অনৈতিক। তাই সুইডেনের মতো শান্তিপ্রিয় দেশ পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহারের ফলে সৃস্টি হওয়া ভোগান্তিকে সমর্থন করতে পারে না।’’
নারীদের সেসব বক্তব্য আবেগী হিসেবে সমালোচিত হলেও আরো কয়েকটি সংগঠন তাদের সঙ্গে এক হয়। পরমাণু অস্ত্রের পক্ষের অবস্থান ধীরে ধীরে দুর্বল হতে শুরু করে। সুইডেনের সেনা, বিমান এবং নৌ বাহিনীও বুঝতে পারে, পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রকল্প হবে অনেক ব্যয়বহুল এবং যে ব্যয় মেটাতে তিন বাহিনীর বাজেট থেকে অর্থ নেওয়ার প্রয়োজন হবে। সুইডেনের উচ্চবিত্তরাও পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তারা বলে, সুইডেনের আলাদা করে পরমাণু অস্ত্রের প্রয়োজন নেই কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যেই সুইডেন রয়েছে।
পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত উপাদন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানী করতে থাকে সুইডেন। তবে সুইডেনের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিলো নেতিবাচক।
১৯৬০ সালে রাজনীতিবিদ এবং কূটনীতিক আলভা মিরডালের নেতৃত্বে সুইডেনে পরমাণু অস্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান জোরালো হয়। এ অবস্থানের কারণে শুরুতে যারা পরমাণু অস্ত্র তৈরির পক্ষে সমর্থন দিচ্ছিলো তারাও শুধুমাত্র গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে মত পাল্টান। ১৯৬৬ সালে পরমাণু অস্ত্র তৈরির সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সুইডেন। ২০১২ সালে সুইডেন পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্য প্রস্তুতকরা প্লটোনিয়ামের শেষ অংশও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করে।
রোজেনগ্রিন মনে করেন, পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে একটি দেশকে তার থেকে প্রযুক্তিগত দিকে বেশি অগ্রসর দেশের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে, যেখানে নির্ভরতা তৈরি হতে পারে। এরপর পরমাণু অস্ত্রের প্রয়োজনিয়তা সম্পর্কে দেশের জনগণকে বোঝানোর জন্য প্রয়োজনীয় আলোচনার সময় বের করতে হবে। জনগণকে বোঝাতে হবে; দেশের জন্য এ অস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা।