হাসিনা সরকারের আমল থেকেই গুঞ্জণ রটে সেন্ট মার্টিনে ঘাটি গড়বে আমেরিকা। কিন্তু কেন? সেন্ট মার্টিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন এতো প্রিয়? আসুন জেনে নেই।
আমেরিকা, যাকে বলা হয় বিশ্ব মোড়ল। অর্থাৎ বিশ্বে যা কিছু হচ্ছে, তার সবই অথবা সব না হলেও বেশিরভাগই হচ্ছে আমেরিকার মদদে অথবা মৌনসম্মতিতে। তাদের আজকের এই অবস্থান ওভার নাইট তৈরি হয়নি। অথবা বেড অফ রোজেজ এর মতও না। এই অবস্থায় আসতে বহু সময়, প্রচেষ্টা, সুনির্দিষ্ট প্ল্যান, প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি, কঠোর পরিশ্রম ও ভাগ্যের প্রয়োজন হয়েছে। সবচেয়ে বেশি যেটি সহায়তা করেছে, তা হলো ভৌগোলিক অবস্থা।
আমেরিকার এক দিকে আটলান্টিক আরেক দিকে প্রশান্ত মহাসাগর। যার ফলে মহাসাগরের মতো এত বিশাল দুর্গম জলপথ পাড়ি দিয়ে বহিরাগত কোনো শক্তি স্বাধীনতার পরে তাদের উপর কখনোই বল প্রয়োগ করতে আসেনি অথবা পারেনি। কিন্তু আমেরিকা ঠিকই সারা বিশ্বে বহুবছর ধরেই ছড়ি ঘুরিয়ে দাপট দেখিয়ে আসছে।

বিশেষ করে ইউরোপ ধ্বংস হওয়ার সুযোগেই বিশ্বযুদ্ধে অক্ষত ও চাঙ্গা অর্থনীতির দেশ আমেরিকা বিশ্ব সিংহাসন দখল করে নেয়। যুদ্ধে প্রাথমিকভাবে নিরপেক্ষ থাকলেও কিছুদিন পর তারা কিছু কৌশলগত ভূমিকা পালন করে। ‘ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি’ নীতি নামে মিত্রশক্তিকে অর্থের বিনিময়ে অস্ত্র সরবরাহ এবং ‘লেন্ড-লিজ’ আইন নামে সামরিক সহায়তা করে। যা আমেরিকাকে ইউরোপের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে।
যুদ্ধপরবর্তী সময়ে তারা প্রথমে ইউরোপকে আর্থিক সহায়তা দেয় এবং পরবর্তী কোনো যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হলে সামরিক প্রতিরক্ষা হিসেবে ‘ন্যাটো’ নামক সামরিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। যার মূল চালক আমেরিকা। এরপর ধীরে ধীরে তারা তাদের সামরিক শক্তিকে সম্প্রসারণ করতে সারা দুনিয়ার গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে সামরিক ঘাটি তৈরির কাজ হাতে নেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদেরকে ৫০টি যুদ্ধ জাহাজ ধার দেয়ার বিনিময়ে আমেরিকা ব্রিটিশদের সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত সব নৌঘাঁটিতে প্রবেশ অধিকার নেয়। ফলে অনেকটা রেডি টু ইট এর মতো করে সহজেই ব্রিটিশদের নৌঘাঁটিগুলোতে তাদের সামরিক শক্তি প্রতিষ্ঠা করে বিশ্ব মোড়ল হওয়ার দৌড়ে আরো অনেক বেশি এগিয়ে যায়।

এভাবেই সারা বিশ্বের প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলেই মার্কিনীদের নৌ ও সামরিক ঘাটি প্রতিস্থাপিত হলেও দক্ষিণ এশিয়ার পিক পয়েন্ট বঙ্গোপসাগরে তাদের কোনো নৌ ও সামরিক ঘাটি নেই। এ কারণেই সাম্প্রতিক কালে বিশেষ করে বিগত শেখ হাসিনার সময়ে বারবার সেন্ট মার্টিন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সেন্ট মার্টিনে আমেরিকার ঘাটি তৈরির অপচেষ্টার গুঞ্জণ ঘনীভূত হয়।
বলা বাহুল্য সেন্ট মার্টিনে আমেরিকা ঘাটি তৈরি করতে পারলে তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী এবং বিশ্বের উদীয়মান পরাশক্তি চীনকে টেক্কা দেয়া খুবই সহজ হয়ে যাবে। পাশাপাশি আরেক উদীয়মান পরাশক্তি ভারতকেও নজরে রাখা যাবে। চীন মনে করে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সামরিক শক্রির চেয়ে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক শক্তির বেশি প্রয়োজন হবে ৷ ফলে তারা তাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে ‘মেড ইন চায়না’ ও ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ নামে পলিসি গ্রহণ করেছে।
মেড ইন চায়না’র আওতায় পণ্য উৎপাদন করবে আর বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এর আওয়াতায় সেগুলো সারা বিশ্বে রফতানি করবে। যেহেতু তাদের প্রচুর পরিমাণ উৎপাদন করতে হয়, সেহেতু তাদের প্রচুর বিদ্যুৎ শক্রির প্রয়োজন হয়। চীনের নিজস্ব জ্বালানিশক্তি নেই বললেই চলে, ফলে জ্বালানীর জন্য তাদেরকে আমদানির উপরেই নির্ভর করতে হয়। আর এই জ্বালানি আমদানির প্রায় সবটাই আসে ইরান থেকে।
ইরান থেকে তাদের এই জ্বালানি চীনে পৌছায় আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগর দিয়ে। আরব সাগর দিয়ে পাকিস্তান হয়ে কারাকোরাম পর্বতের নিচ দিয়ে তারা দীর্ঘ পাইপলাইন তৈরি করেছে, অন্যদিকে বঙ্গোপসাগর হয়ে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ দিয়েও তাদের সুবিশাল পাইপলাইন রয়েছে। সুতরাং পরবর্তী বিশ্ব পরাশক্তি ও আমেরিকার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে প্রতিহত করতে বঙ্গোপসাগরে আমেরিকার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। আর বঙ্গোপসাগরে আমেরিকার আধিপত্য স্থাপনের এখন সবচেয়ে বড় যে অনুষঙ্গের প্রয়োজন, তা হলো সেন্ট মার্টিন।